মৈমনসিংহ গীতিকা ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রাচীন পালাগানের সংকলন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীনেশচন্দ্র সেন বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলা থেকে স্থানীয় সংগ্রাহকদের সহায়তায় প্রচলিত এ পালাগানগুলো সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে মৈমনসিংহ গীতিকা (১৯২৩) নামে গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। গ্রন্থটি বিষয়মাহাত্ম্য ও শিল্পগুণে শিক্ষিত মানুষেরও মন জয় করে।
মৈমনসিংহ গীতিকায় ১০টি গীতিকা স্থান পেয়েছে, যথা—মহুয়া, মলুয়া, চন্দ্রাবতী, কমলা, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা, রূপবতী, কঙ্ক ও লীলা, কাজলরেখা ও দেওয়ানা মদিনা।
বাংলার ইতিহাস (মুসলিম বিজয় থেকে সিপাহী বিপ্লব পর্যন্ত) -আবদুল করিম
ভনিতা থেকে কিছু গীত রচয়িতার নাম জানা যায়, যেমন মহুয়া—দ্বিজ কানাই, চন্দ্রাবতী- নয়ানচাঁদ ঘোষ, কমলা- দ্বিজ ঈশান, দস্যু কেনারামের পালা- চন্দ্রাবতী, দেওয়ানা মদিনা- মনসুর বয়াতি। কঙ্ক ও লীলার রচয়িতা হিসেবে ৪ জনের নাম পাওয়া যায়- দামোদর দাস, রঘুসুত, শ্রীনাথ বিনোদ ও নয়ানচাঁদ ঘোষ। অবশিষ্ট গীতিকার রচয়িতার নাম জানা যায় না।
গীতিকায় রচয়িতার নাম থাকলেও তাঁদের স্বতন্ত্র কবিত্বের চিহ্ন নেই; বরং বিষয়বস্ত্ত, শিল্পাঙ্গিক, ভাষাভঙ্গি ও পরিবেশনা রীতি অভিন্ন বলেই প্রতিভাত হয়। আখ্যানগুলি লোকসমাজ থেকেই গৃহীত হয়েছে। ধর্ম নয়, পার্থিব জীবনকথা গীতিকার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
মৈমনসিংহ গীতিকার দস্যু কেনারামের পালা ছাড়া বাকি ৯টি পালার মুখ্য বিষয় নরনারীর লৌকিক প্রেম। প্রেমের পরিণতি কোনোটির মিলনাত্মক, কোনোটির বিয়োগান্তক। নায়িকার নামানুসারে গীতিকাগুলির নামকরণ হয়েছে। গীতিকাগুলিতে পুরুষ চরিত্রের তুলনায় নারী চরিত্রের ভূমিকা উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। প্রেমের প্রতিষ্ঠায় তারাই বেশি সংগ্রাম ও ত্যাগ স্বীকার করেছে।
নারীদের একনিষ্ঠ প্রেম ও বলিষ্ঠ চরিত্র থেকে অনেকে মনে করেন, গীতিকাগুলিতে কোনো মাতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রভাব থাকতে পারে। নারী-চরিত্রের মহিমা কীর্তন করে দীনেশচন্দ্র সেন গ্রন্থের ভূমিকায় বলেন, ‘এই গীতিকাগুলির নারী চরিত্রসমূহ প্রেমে দুর্জয় শক্তি, আত্মমর্যাদার অলঙ্ঘ পবিত্রতা ও অত্যাচারীর হীন পরাজয় জীবন্তভাবে দেখাইতেছে। নারীপ্রকৃতি মন্ত্র মুখস্থ করিয়া বড় হয় নাই—চিরকাল প্রেমে বড় হইয়াছে।’
জাসদের উত্থান পতন : অস্থির সময়ের রাজনীতি -মহিউদ্দিন আহমদ
রচয়িতাদের আবির্ভাব কাল, কাব্যের জীবনকথা, আর্থ-সামাজিক পটভূমি, ভাষাদর্শ ইত্যাদি ব্যাখ্যা করে গীতিকাগুলি মধ্যযুগে রচিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। ‘কাজলরেখা’ রূপকথাধর্মী; এর বিষয়বস্ত্ত প্রাচীন।
এটি ছাড়া অন্য সব গীতিকায় সামন্ত যুগের সমাজচেতনার ও মূল্যবোধের ছায়াপাত রয়েছে। রাজা, জমিদার, দেওয়ান, কাজী, কারকুন, সওদাগর, পীর-দরবেশ, সাধু-সন্ন্যাসী প্রভৃতি চরিত্র মধ্যযুগের মুসলিম শাসন-ব্যবস্থাকেই সূচিত করে।
সামন্তসমাজের মূল্যবোধ ধারণ করেও মানবপ্রেমের মহিমা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, ইহজাগতিকতা এবং নৈতিকতা মৈমনসিংহ গীতিকাকে এমন সাহিত্যিক মূল্য ও মর্যাদা দান করেছে, যা আধুনিক যুগের উপন্যাসের সঙ্গে তুলনা করা যায়।
এ প্রসঙ্গে পূর্ববঙ্গ গীতিকার কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। মৈমনসিংহ গীতিকা প্রকাশিত ও সমাদৃত হওয়ার পরে দীনেশচন্দ্র সেন ময়মনসিংহ, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আরও অনেক গীতিকা সংগ্রহ ও সম্পাদনা করে পূর্ববঙ্গ গীতিকা (১৯২৬) নামে মোট তিন খন্ডে প্রকাশ করেন। স্থানীয় গ্রামের মানুষ এগুলিকে ‘পালাগান’ নামে অভিহিত করে থাকে।
দীনেশচন্দ্র সেন ইংরেজি ballad-এর বাংলা পরিভাষা হিসেবে ‘গীতিকা’ শব্দটি গ্রহণ করেন। বাংলা গীতিকা বর্ণনামূলক গীতি-আলেখ্য; তবে এতে প্রচুর নাটকীয় ঘটনার এবং চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তিমূলক সংলাপেরও স্থান আছে।
একজন গায়েন আনুপূর্বিক ঘটনার বিবরণ ও চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তি গান করে পরিবেশন করেন; দোহাররা ধুয়া গেয়ে এবং বাজনদাররা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তাঁকে সাহায্য করে। গ্রামের সাধারণ মানুষ এর দর্শক-শ্রোতা; তারা আসরে বসে মুগ্ধচিত্তে গীতিকার গীতিরস ও নাট্যরস উপভোগ করে।