সংসার – আল শাহারিয়া

সংসার তরুণ লেখক আল শাহারিয়া’র লেখা ছোটগল্প। আশা করি, লেখাটি উপভোগ করবেন।

নিশ্চুপ ঘরটা সন্ধ্যের নিরবতায় ভরে আছে। ঘরের কোণটায় মোমবাতি আলো ছড়াচ্ছে ধীরে ধীরে। চারিপাশ নিশ্চল-স্তব্ধ! কিছুক্ষণ আগে অনেকবেশি ঝড়ো বাতাস‚ বৃষ্টি‚ বজ্রপাত আর বিদ্যুতের ঝলকানি হচ্ছিলো। তাই‚ বিদ্যুৎ নেই শহরে। রাতুল আর নীলা ঘরের দুই প্রান্তে বসে আছে। নীলা মোমবাতির আলোয় চোখ রেখে নিজের কষ্ট-অভিমান পোড়াচ্ছে। চোখ ছেড়ে পানি কপোল বেয়ে গড়িয়ে মুখ ভিজিয়ে দিচ্ছে। এই নিশিত কান্নায় রাতুল কাবু হয় রোজ। আজ কেন জানি হচ্ছে না! রাতুল জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ-ই সে পিছনে ফিরে নীলার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে তাঁর কথাটা বলা ঠিক হয়নি। মেয়েটা আজ অন্য দিনের তুলনায় বেশি কাঁদছে।তাঁকে কি নীলা কখনও বুঝবে না?
নীলা-রাতুলের বৈবাহিক সম্পর্ক তিন বছর হলো।বিয়ের পর রাতুলের চাকরির সুবিধার্থে ঢাকায় থাকে তারা। তিন বছরে এই সংসার জীবনে তারা প্রতি সপ্তাহেই ঝগড়া করে। নীলা একটা ব্যাপারে বেশ খুশি যে যেদিন তাদের ঝগড়া হয় সেদিন রাতুল তাকে বেশি ভালোবাসে। আজ সারাদিন অফিসের কাজ সেরে বাসায় এসেই ঝগড়ার পসরা বসেছে। আজ বিকেল থেকেই চারিপাশ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি আর কালো মেঘে বেশ থমথমে হয়ে ছিলো। বাসায় ফিরতেই নীলা বলল‚’রাতুল‚দেখেছো আজ বিকেলটা কত সুন্দর! আমার বৃষ্টিতে ভিজতে ইচ্ছে করছে‚চলো একসাথে ভিজি।’


রাতুল বেশ নরম ভাবেই বলল‚’তোমার কাল ঠান্ডা লেগেছে। আজ সারাদিনে একটু সুস্থ হয়েছো। তাই‚ এখন বৃষ্টিতে ভেজা ঠিক হবে না।’
‘একটু ভিজলে কিছু হবে না।’ বলেই হাতটা ধরে রাতুলকে নিয়ে গেলো ছাদে। রাতুল অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছাঁদে গেলো। নীলা রাতুলকে জড়িয়ে ধরে বৃষ্টিতে ভিজল মিনিট পনেরো। রাতুলের এসব আজ মোটেও ভাল লাগছে না। তবুও কিছুক্ষণ ভালভাবেই সঙ্গ দিলো নীলাকে। গোলাপি শাড়ি নীলার শরীরে যতটা লেপ্টে আছে তার চেয়ে বেশি লেপ্টে আছে রাতুল।
এরপর বেশ নরম হয়েই রাতুল বলল‚’চলো এবার নিচে যাই।’
নীলা রাতুলের কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে মনটা খারাপ করে নিচে রুমে চলে গেলো। একটা কথাও আর বলল না। রাতুলকে কাছে ডাকলো না। রাতুল নিচে গিয়ে দেখলো নীলা শাড়ি পরিবর্তন করে এসেছে। চুল মুছতে মুছতে এসে রাতুলকে টাওয়াল দিয়ে গেলো কিন্তু কোনো কথা বলল না। রাতুল নীলার মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝলো মনটা বেশ খারাপ। রাতুল আর বিশেষ কিছু না বলে পোশাক পরিবর্তন করে নিলো। সোফায় বসে ই-মেইল চেক করতে করতে নীলাকে বলল‚’চা করে দেবে?’
নীলা রুমেই ছিলো কিন্তু রুম থেকে কোনো আওয়াজ বের হলো না। রাতুল তখন ল্যাপটপ রেখে সোফা থেকে উঠে রুমের দিকে গেলো। ভিতরে গিয়ে দেখলো নীলা কাঁদছে। রাতুল আরেকটু কাছে গিয়ে নীলার পাশে বসে হাত ধরতেই জোরে ঝটকা দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিলো। অদূরে কোথাও ভীষণ জোরে বজ্রপাত হলো। আজ বজ্রপাতে নীলা ভয় পেয়ে রাতুলকে জড়িয়ে ধরলো না। আর্তনাদ প্রস্ফুটিত গলায় বলল,’আমি এভাবে আর থাকতে পারছি না। এতো সীমাবদ্ধতা ভালো লাগছে না আমার। আমার মুক্তি প্রয়োজন।’এটা বলে নীলা ড্রয়িং রুমে চলে গেলো।

‘গল্পলেখকঃ আল শাহারিয়া। ছবিঃ রুহিন রুমি’


রাতুল বিশেষ কিছু বলল না। সে-ও ক্রমশ বিরক্ত হয়ে উঠেছে নীলার প্রতি। তারপর একঘন্টা যাবৎ এভাবে বসে আছে তারা। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। পাশের গাছে বাতাস লেগে শা-শা শব্দ হচ্ছে‚ বৃষ্টি শেষে এখন ঝি-ঝি পোকা ডাকছে। আজ রাতে রান্না হয়নি। রান্নার লোক গ্রামে বাড়িতে গিয়েছে। তার বাবা অসুস্থ। নীলা ঠিকঠাক রান্না করতে পারে না। রাতুল অবশ্য অফিস থেকে ফিরে নীলাকে সাহায্য করে রান্নায় যেদিন রান্নার লোক আসে না। রাতুলের ফোনে হঠাৎ কল এলো। প্রথমবার কেউই ফোন রিসিভ করলো না। পরেরবার দুজনই পিছনে ফিরে সোফার সামনে থাকা টেবিলের উপর রাখা মোবাইলের দিকে তাকালো। নীলা অবশ্য উঠলো না,রাতুলই মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো রাতুলের বাবা কল করেছে। কল রিসিভ করে সালাম দিলো রাতুল। ওপার থেকে সালামের উত্তর এলো। বাবা পরে কিছু না বলায় রাতুলই বলল,’বাড়ির সবাই কেমন আছে?’


‘ আলহামদুলিল্লাহ্ আমরা সবাই ভালো আছি, বাবা। তোদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো? নীলা মা কি করছে?’
‘না‚ আব্বু। কোনো সমস্যা নেই। ও আছে আমার পাশেই।চিন্তা করো না।’
‘আচ্ছা নে মায়ের সাথে কথা বল।’
‘আব্বু‚ আসলে আজ বিদ্যুৎ নেই। একটু ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে তো তাই। অফিসে থেকে মোবাইলে চার্জ দিতে পারনি।’
‘ও। আচ্ছা। সকালে কথা বলিস।’
‘আচ্ছা‚আব্বু।’ বলেই কেটে দিলো কলটা। রাতুল সাধারণত মিথ্যা কথা বলতে পছন্দ করে না। নীলার সাথে ৬ বছরের প্রেমে অনেকবারই এই মিথ্যা নিয়ে কথা শুনিয়েছে রাতুল নীলাকে। সেই রাতুলই যখন ‘সব ঠিক আছে’ বলল তাঁর বাবাকে তখন নীলা যেন কেমন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রাতুলের দিকে। অবশ্য সেদিকে কোনো খেয়ালই করেনি রাতুল। বাবা-মায়ের চিন্তা কমাতে‚ নিজেদের সম্মান বাঁচাতে মিথ্যা কথা বলেছে। রাতুল এটাকে দোষ হিসাবে নিচ্ছে না। রাতুল ফোনটা আবার সোফার উপর রেখে নীলাকে বলল‚’আজ রান্না হয়নি তাই না?’


নীলা তখনও চুপচাপ। আর কথা বলে বিশেষ লাভ হবে না বুঝে রাতুল ফ্রিজে আগের খাবার আছে কি-না দেখতে গেলো। ফ্রিজে আগেরদিনের মাংস আছে। রাত তখন প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে। বিদ্যুৎ না আসায় রাতুল ভেবেই নিলো লাইনের তার ছিড়ে সংযোগ বিচ্ছিন হয়ে গিয়েছে,রাতে আর বিদ্যুৎ আসার সম্ভাবনা নেই। রাতুল খাবার গরম করতে গেলো রান্নাঘরে। খাবার গরম কোনোভাবে শেষ করেই ভাত চাপালো। রান্নাটা আলগোছে শেষ করে খাবার নিয়ে টেবিলে সাজালো রাতুল। সবকিছু গুছিয়ে নীলাকে বলল,’খাবে এসো। আজ আমি খাইয়ে দেবো।’
নীলা আসলো না ।বরং আলাদা একটা রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। রাতুলের আর খাওয়া হলো না‚ এমনিতেই ঝগড়া হলে সে রাতে রাতুল কিছু খায় না। নীলার জানালার কাছে গিয়ে দেখলো নীলা ঘুমানোর চেষ্টা করছে। তাই নীলাকে না ডেকে রাতুল নিজের রুমে গেলো।

নীলার রুমের পাশেই অনেক গাছপালা আছে। আজ সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙলো তার। পাশে তাকিয়ে রাতুলকে পেলো না। নীলা রাতুলকে তার পাশে আশা করেছিলো। বিষন্ন মন নিয়ে আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থাকলো নীলা। আজ সে রাগ করেছে অথচ কেউ এসে তাকে ডাকছে না। দরজা বন্ধ তাতে কি জানালা দিয়ে তো অন্তত ডাকতে পারে। কিন্তু কেউ আসলো না। যা নীলাকে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। সে আর অপেক্ষা না করে দরজা খুলে বাইরে বের হলো। টেবিলের উপর খাবার তেমনই রাখা। তার মানে রাতুলও খায়নি রাতে। নীলা রাতুলের রুমের দিকে গেলো। দরজার কাছাকাছি গিয়ে দরজা আস্তে ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো। খোলাই ছিলো। নীলা ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলো। ঘরে কেউ নেই। বুকের ভিতর কেমন যেন এক শূন্যতা অনুভব করলো। রুম থেকে বের হয়ে সমস্ত বাড়ি ঘুরে দেখলো কিন্তু কোথাও কেউ নেই। এবার নীলার কান্না পেয়ে আসছে। ভয়‚ একাকীত্ব ঘিরে ধরছে তাঁকে। কি করবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। চোখ আঁটকে গেল টেবিলে। টেবিলের উপর একটা বড় পৃষ্ঠা দেখে অবাক হয়ে গেলো। তবে কি সে যা ভাবছে তা সত্যি হবে? কম্পিত হাতে পৃষ্ঠা হাতে নিয়ে দেখলো বেশ বড় করে লেখা কিছু।

পড়া শুরু করলো নীলাঃ
‘প্রিয়তমা আমার,
৬ বছরের প্রেম আর ৩ বছরের সংসার জীবন অনেকটা সময়। সুদীর্ঘ ৬ বছর কোনো প্রেমিক-প্রেমিকা একসাথে থাকতে পেরেছে এমনটা খুব কম দেখা যায়৷ আমরা একসাথে থাকতে পেরেছি আমাদের কিছু ত্যাগ আর অগাধ ভালোবাসার কারণে। তুমি আমাকে কত ভালোবাসো তা আমি জানি। কিন্তু‚ তুমি আমার অস্তিত্বে এখন ভালোবাসা খুঁজে পাচ্ছো না। নয়ত আমার ভালোবাসা কমে গেছে তোমার প্রতি। আমি অনেক দূরে চলে যাচ্ছি। এই শহরে আমাকে আর পাবে না। তবে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। আমি তোমার কাছে একদিন ঠিকই ফিরবো। কোনো কনকনে শীতের সকালে ভীষণ কুয়াশার রাজত্বে আমাদের হুট করে দেখা হয়ে যাবে। সেদিন আমার শক্ত চুলের উপর কুয়াশার এঁকে দেওয়া শুভ্রতা তোমার পথচলা থামিয়ে দেবে। তোমার তুষার শুভ্র চোখে চোখ পড়ে গেলে আমি তা অতিক্রম করতে পারবো না কখনও। তোমার ব্যাংক একাউন্টে আমি যত টাকা রেখেছি তাতে ১-২ বছর ঠিকঠাক চলে যাবে তোমার। তাছাড়া‚ তোমার চাকরিটা তো আছেই। তুমি তুমি নিশ্চয় এখন আমাকে খুঁজছো‚অনেক ভালোবাসা অনুভব হচ্ছে আমার জন্য। কিন্তু‚ আমি রাতেই ঠিক করে নিয়েছিলাম তোমাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে যাবো। তুমি মুক্ত পাখির মতো আকাশে উড়বে‚ সীমাহীন হোক আকাশ তোমার। আমাকে খোঁজ করার চেষ্টা না করতে অনুরোধ জানাচ্ছি। বাবা-মায়ের কাছে চাইলেই তুমি ফিরে যেতে পারো। তুমি অনেক কবিতা পছন্দ করতে। তাই শেষ সময়ে একটা ছোট্ট কবিতা তোমাকে উৎসর্গ করলাম।

“এই বিচ্ছেদে যন্ত্রণা যতটা
একাকীত্বের বৃষ্টি যতটা
হৃদয় ভেঙ্গে ভালো রাখা ততটা।
অন্ধকারে সুখে বেঁচে থাকা
বিচ্ছেদে সুখানুভূতির কবিতা।
এই শূণ্যতা অসহ্য হলেও সুন্দর‚
এই নিরবতা নৈশব্দ হলেও অস্থির।
তবু,আমার সুন্দর স্মৃতি নিয়ে
অথবা অন্য কোনো অবয়বে
ভালো থেকো তুমি‚ প্রিয়তমা।”‘

চিঠি পড়তে পড়তে বেদনায় চোখ ভিজে এলো নীলার। মেয়েটা কান্না মোটেও ধরে রাখতে পারে না। নৈশব্দ কান্না কপোল ছুঁয়ে দিতে না দিতেই আর্তনাদে ভেসে গেলো ঘর। এ কোন একাকীত্ব ঘিরে ধরেছে তাকে!
নীলার বাড়িতে যেন আজ উৎসব বেঁধে গেছে। বাড়ি লোকজনের সমাগমে যারপরনাই চঞ্চল। ছোট্টো ছেলে-মেয়েগুলো খেলনা নিয়ে বারান্দায় খেলা করছে। খুব ছোটো বাচ্চাদের কান্না শোনা যাচ্ছে পাশের বাড়ি থেকে। নীলার মা তহুরা বেগম যেন পুরো বাড়িটায় সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত। কত দায়িত্ব আজ তার। ছোটো মেয়ে হিয়া আর তাঁর জামাই তৌফিক আসছে বিদেশ থেকে অনেকদিন পর। মেয়ের পছন্দের খাবার রান্না হচ্ছে‚ বাড়ি ঘর গোছানো হচ্ছে। এই অনুষ্ঠানে নীলাকে কেউ আশা করেনি সেদিন। যদিও বোনের আসার কথা আগেই জানানো হয়েছিলো তাঁকে। দুপুরের উষ্ণ রোদে পুড়ে বাড়িতে এসে হাজির নীলা। নীলাকে দেখে বাবা-মা যতটা না অবাক হলো তার চেয়ে অবাক হলো রাতুলের অনুপস্থিতিতে। বিয়ের পর থেকে আজ পর্যন্ত নীলাকে কখনো একা আসতে দেয়নি রাতুল। প্রতিবারই বাধ্য ছেলের মতো নীলার আঁচল ধরে চলে আসে রাতুল কিন্তু এবার এলো না। বাড়ির গেইটের সামনে আসতেই তহুরা বেগম এগিয়ে গেলো নীলার দিকে। তখন তিনি রান্নাঘর থেকে অন্য ঘরে যাচ্ছিলো কিছু একটা আনার জন্য। নীলাকে দেখে সেকেন্ড কয়েক স্তব্ধ থেকে নীলার দিকে এগিয়ে গেলো। বিষ্ময়ের সঙ্গে বলল‚’কি-রে মা তুই হঠাৎ কোনো খবর না দিয়ে?জামাই কই?’
নীলার জানাই ছিলো এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে। তাই আগে থেকেই গ্রহণযোগ্য একটা উত্তর প্রস্তুত করেই সে এসেছে। নীলা অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই বলল‚’ও আমেরিকায় গেছে। হঠাৎ যেতে হলো তাই বলে যেতে পারিনি।’তহুরা বেগম এবার স্বাভাবিক হয়ে বলল‚’আচ্ছা। ফোন তো করতে পারতিস একবার। তবে চলে এসে ভালো করেছিস। আয় ঘরে আয়।”

নীলা কিছু না বলে মায়ের সাথে ঘরে গেলো।
ঘরে গিয়ে দেখলো বাবা জাহিদ মিঞা শুয়ে আছে খাটের উপর। তার প্রচন্ড জ্বর এসেছে হঠাৎ। কারণ,বাজারে গিয়ে রোদে রোদে ঘুরে বাজার করেছে সে। বাবার পাশে গিয়ে বসলো নীলা। ঘিরে থাকা চিন্তাগুলো হঠাৎ এমনভাবে আধিপত্য দেখালো যে বাবা নীলাকে রাতুলের সম্পর্কে জানতে চাইলেও নীলা জবাব দিলো না। যেন খেয়ালই নেই সে কোথায়! পরে বাবা ওর মাথায় হাত দিয়ে বলল‚’কি-রে মা।কি হয়েছে?জামাই আসেনি কেন?’
হঠাৎ‚ চিন্তার জগৎ ভেঙ্গে মাথা নিচু করে বলল,’ও অফিসের কাজে দেশের বাইরে গেছে।’
জাহিদ মিঞা আর কিছু বলল না। জাহিদ মিঞা যেমন নীলাকে খুব ভালোবাসে তেমন তার নীলাও। ছোট বেলার কথা মনে পড়ে গেলো নীলার। সেবার মেলায় গিয়ে বায়না ধরেছিলো নাগরদোলায় চড়বে। সবার নিষেধ সত্ত্বেও জাহিদ মিঞা তাকে নাগরদোলায় উঠিয়ে দিয়েছিলো তারই ৫ বছরের বড় চাচাতো ভাই রিফাতের সাথে। নাগরদোলায় উঠতেই নীলা চিৎকার শুরু করে দিলো। তা দেখে বাবার সে কী অস্থিরতা! নাগরদোলা চালককে জোর করে ধরে নাগরদোলা থামালো। কান্না-ভয়ে একাকার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে সে-ও কেঁদে ফেলল।
এসব ভাবনা শেষ হতে না হতেই জাহিদ মিঞা বলল,”যা‚ মা। ঘরে যেয়ে হাত-মুখ ধুয়ে নে।
নীলা স্বাভাবিক হয়ে জাহিদ মিঞাকে বলল‚’আচ্ছা‚ যাচ্ছি। তুমি অসুস্থ হলে কি করে? ঔষধ খেয়েছো?’
রান্নাঘর থেকে তহুরা বেগম আবার বাবার ঘরে আসতে আসতে ‘রোদে ঘুরে ঘুরে বাজার করেছে তা কি হবে আর? আমার একটা কথা যদি শোনে!’
জাহিদ মিঞা হাসতে হাসতে বলল‚’হ্যাঁ খেয়েছি। এখ ন জ্বর-মাথা ব্যথা কম মনে হচ্ছে।’
‘ও। এবার তাহলে তুমি ঘুমানোর চেষ্টা করো। রোদে ঘুরঘুর করা ঠিক হয়নি তোমার।’ এই কথা বলেই নীলা নিজের ঘরে চলে গেলো।
রাতুলের লম্বা চুল উড়ছে বাতাসে। অভির বাড়িতে যেতে ছোট্টো এই নদীটা পার হতে হয়। অভি হলো রাতুলের অনেক কাছের বন্ধু। বাসা থেকে বের হওয়ার পর রাতুল রাস্তার টং দোকানে দাড়িয়ে চা খাচ্ছিলো। এই চায়ের স্বাদ তার কাছে অন্য যেকোনো চা-য়ের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ভালো। হঠাৎ তার সামনে এসে একটা পরিচিত মুখ দাড়ালো।এ-তো অভি! অভিকে দেখে রাতুল ভীষণ আনন্দ অনুভব করলো। জাড়িয়ে ধরলো একে অপরের ৬ বছরের বন্ধুকে। অভি গ্রামে যাওয়ার পর আর যোগাযোগ হয়নি তাদের। অভি ঢাকায় এসেছিলো তার খামারের জন্য জিনিসপত্র কিনতে। চায়ের দোকানের পাশেই আছে একটা বেশ বড় মুরগির খাবারের ফ্যাক্টরি। পিক-আপ ভ্যানে খাবার উঠিয়ে দিয়ে সে-ও চা খেতে এসেছিলো। টং দোকানের চা খাওয়ার অভ্যাস তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই। চা খেতে খেতে একে অপরের জীবন সম্পর্কে জানাজানি করলো। অভির বিয়ে সামনে। অভি রাতুলের কথা শুনে রাতুলকে বলল‚’তুই চল আমার সাথে থাকবি।’ রাতুল প্রথমে না না করলেও পরে রাজি হয়ে অভির গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করলো। অভি গ্রামের ছেলে হলেও বেশ স্বচ্ছল। এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে অভি গ্রামে এসে খামার করে এখন বেশ ভালোভাবেই দিন চালাচ্ছে। অভি গ্রামের ছেলে তাই প্রথম থেকেই গ্রাম পছন্দ করতো। অন্যদিকে রাতুল ছিলো অনেকটা শহর-মনা। শহুরে সংস্কৃতি তার বেশ টানতো। স্কুল – কলেজ – ইউনিভার্সিটি জীবনে সে অনেক সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ করতো‚মিউজিক কন্সার্ট‚কলেজের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতো। অভি সবসময় এসবের বাইরে থাকার চেষ্টা করতো।
নীলার সাথে রাতুলের প্রেম হওয়াটা তাদের পছন্দের জন্য। নীলা অনেক কবিতা আবৃত্তি করতে পছন্দ করতো‚ আর রাতুল লিখতে। স্কুল-কলেজে জীবনে অনেক কবিতা লিখেছে সে নীলাকে নিয়ে। যদিও কলেজজীবন থেকেই ওদের প্রেম। বিয়ের পর কর্মব্যস্ততার কারণে তেমন লেখালেখি করতে পারে না‚এই নিয়ে নীলার যত মনখারাপ। নীলা তো প্রায়ই অভিযোগ তোলে যে ভালোবাসা কমে গিয়েছে।
রাতুল অনেক বেশি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। কিন্তু‚ নদীর স্বচ্ছ পানিতে তাকিয়ে দেখে আরেক আকাশ নদীতে মিশে আছে। হঠাৎই সেই আকাশের বুকে যদি তাঁর আকাশনীলার আগমন ঘটে! এমন চিন্তায় আবার সে মনে করলো নীলাকে। রাতুল অনেক অদ্ভুত খেয়ালের মানুষ। ১৫৪৫ লিখলো নিজের ডায়রীতে। এ নিয়ে ১৫৪৫ বার স্মরণ করলো সে নীলাকে।
তখন তারা প্রায় মাঝ নদীতে। অভি বলল,’কি লিখছিস আবার? কবিভাব এখনও ধরে রেখেছিস? রাতুল‚ সাঁতার জানিস তো?’
রাতুলের মগজ থেকে যেন নীলা ছিটকে গেলো। পিছনে ফিরে হাসিমাখা মুখ নিয়ে অভির দিকে তাকিয়ে বলল‚’আমিও গ্রামের ছেলে‚ বন্ধু। ছোটবেলায় অনেক নদী সাঁতারে পার হয়েছি।’
‘তোর তো এলেম আছে দেখছি। হাহাহা!’
‘হ্যাঁ তা তো আছেই।’ অভি রাতুলের ব্যাপারে সব জানলেও এখন রাতুল মনখারাপ করে নীলাকে মনে করছে তা বুঝতে পারলো না।
রাতুল বলল,’এই গরমের সময়টায় নৌকা ভ্রমণ বেশ লাগে। এখন একটু রোদের তেজ কম। মোটামুটি ভালোই লাগছে।’
‘হ্যাঁ।’
‘তোর মনে আছে তোর গ্রামে গিয়েছিলাম একবার? কাকিমা কী যত্নটাই না করেছিলো আমাকে! কাকু-কাকিমা কেমন আছে?’
নদীর জলে চোখ রেখেই থমথমে মুখে জবাব দিলো‚’ভালো আছে।’
‘তোর মায়ের হাতের মুরগির মাংস আর খিচুড়ি বেশ লাগে খেতে।’
এবার অভির দিকে চেয়ে বেশ হাসিমাখা মুখে বলল‚’আমি মায়ের হাতের খিচুড়ি খেতে খুব পছন্দ করি। এখনও।’
মুখে দুষ্টু হাসি নিয়ে রাতুল বলল‚’বিয়ের পর ভাবিকে নিয়ে চল। কব্জি ডুবিয়ে খিচুড়ি আর মাংস ভুনা খেয়ে আসা যাবে। শহরের চাইনিজ খাবার খেতে খেতে সেই স্বাদ হারিয়ে ফেলছি ক্রমশ।’
‘আচ্ছা সে যাওয়া যাবে। আগে আমার মায়ের রান্না খেয়ে নে। চল এখন বাড়ি ফিরি। রাতে খামারে যাবো একসাথে।’
নৌকা ঘাটে বেঁধে রেখে ওরা বিশাল সীমানা দিয়ে ঘেরা বাড়িতে গেলো। অভির মা-কে সালাম করলো রাতুল। তারপর ওদের ওকে শরবত দিয়েই ওর পাশে বসে বলল‚’তোমার বন্ধুর বিয়ের সব দায়িত্ব কিন্তু তোমার। আমার বয়স হয়েছে এখন।তুমি এসে ভালো করেছো।’
অভির মা রাতুল-নীলার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। শুধু জানে নীলা ভালো আছে আর রাতুল নীলাকে বাবার বাড়িতে রেখে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে। সে সমস্ত গ্রাম ঘুরে দেখবে বাংলাদেশের। অভির মা অবশ্য বলেছে নীলাকে আনলে ভালো করতো। রাতুল কোনোভাবে ব্যাপারটা সামাল দিয়েছে।


বাড়িতে এসে গোসলের জন্য তারা পুকুরে গেলো। বেশ বড় পুকুর! পুকুরপাড়ে বেশ বড় বড় গাছ। যে কেউ দেখলে বুঝবে বেশ বিত্তশালী মানুষ অভি। শানবাঁধানো ঘাট! পুকুরে বড় বড় মাছের নড়াচড়া লক্ষ্যনীয়। রাতুল ভাবলো এই বিকেলে পুকুরপাড় এতো সুন্দর লাগলে পুর্ণিমা রাতে কতটা সুন্দর হবে। আমি তো নীলাকে বলেছিলাম গ্রামেও সুন্দর একটি বাড়ি বানাবো। তবে বইয়ে পড়া সেই পুরনো গ্রাম আর পাওয়া যাবে কি? সব তো আধুনিকতার ছোঁয়ায় উন্নত হয়ে উঠছে। যোগ হচ্ছে শহুরে যতসব রীতিনীতি। যাইহোক অনেকদিন পর সাঁতরে গোসল করছে রাতুল। গোসলটা বেশ উপভোগ করছে। অভি বলল‚’এই পুকুর থেকেই আমি লাখ টাকার মাছ বিক্রি করি।’
নীলা সেই যে রুমে গিয়ে ঢুকেছে বের হওয়ার নাম-ই নেই। তহুরা বেগম কাজে এতই ব্যস্ত যে নীলার কথা তার মনেই নাই। নীলা একা ঘরে ভীষণ একাকীত্ব বোধ করছে। হঠাৎ-ই কি খেয়ালে তহুরা বেগম নীলার ঘরে আসলো। মেয়েকে দেখলো এক দৃষ্টিতে জানালার দিয়ে বাইরে চেয়ে আছে। ঘেমে গিয়েছে নীলা। কপালে ঘাম এমন রূপ নিয়েছে যেন গোসল শেষে মোছা হয়নি। তহুরা বেগম ভুলে গেলো কি কারণে এই রুমে এসেছিলো। ফ্যানের স্যুইচ টিপে দেওয়া মাত্রই মা-কে খেয়াল করলো নীলা। তহুরা বেগম নীলার পাশে বসে ওর কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বিরক্তির সুরে বলল‚’ফ্যান টাও চালাস নি? আমার যে কত কাজ তার উপর বাবা-মেয়ে নিজের কাজ নিজে করবি না। আমি একা কত দিকে খেয়াল দিতে পারি বলতো।’
‘আরে মা আমার কিছু হয় নি।’

‘কিছু হয়েছে কি-না এমন কিছু তো জানতে চাইনি।নিজের কাজ নিজে করতে বলছি।”
নীলা স্বাভাবিক হয়ে‚’আচ্ছা করবো।তুমি যাও কাজ করো,আমি গোসলে যাবো।’
‘এখনো গোসল হয়নি? কি কাজ করছিলি?’
নীলা বিরক্তি নিয়ে বলল‚ ‘কিছু না! তুমি যাও তো।’
তহুরা বেগম কিছুটা শক্ত গলায়‚’গোসল শেষ করে খাবার খেতে আয়। আর ডাকতে পারবো না।’ বলেই তিনি চলে গেলেন।
নীলা এখনও ওনার কাছে বাচ্চা মেয়ে। আসলে বাবা-মায়ের কাছে সন্তান আজীবন অবুঝ আর ছোটোই থাকে।
নীলা বিষন্ন মন নিয়ে গোসলে গেল। ছোটবেলা থেকেই নীলা বাড়ির কাজ কিছুই করতে পারতো না। বিয়ের আগে তার মায়ের কড়া প্রশিক্ষণ নিয়ে সে এখন একজন দক্ষ স্ত্রী ও গৃহিণী। শুধু পারেনি রান্নাটা শিখতে। দক্ষ হয়েও ভালোবাসার মানুষের সাথে স্ত্রীর মতো ব্যবহার না করে প্রেমিকার মতো আচরণ করে ফেলে মাঝেমধ্যে। যা রাতুল খুব অপছন্দ করে।
পাশের বাড়িতেই নীলার থেকে ৩ বছরের ছোট নীলাঞ্জনা থাকে। এই পৃথিবীতে নীলাঞ্জনা আসে বাড়ির সবার মনে আশার আলো ফুটিয়ে। যদিও সে মেয়ে হয়ে জন্ম নিয়ে পরিবারের আশাটা সম্পুর্ন পুরন করতে পারেনি। পরবারের একমাত্র সন্তান সে। আদর ভালোবাসায় কমতি হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। পারিবারিক দারিদ্রতার মধ্যে দিয়েও সবাই তাদের সব সামর্থ্য দিয়ে ভালোবাসে তাকে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান হওয়ার পাশাপাশি দাদু-দাদিমার একমাত্র নাতনী সে। যথাসময়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে দারুণ প্রতিভা প্রকাশের মাধ্যমে দ্রুতই জায়গা করে নেয় স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকার মনে। এতটাই নম্র‚ভদ্র আর শালীন যে ওদের বাড়ির আশেপাশের প্রতিবেশীরা তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ সর্বদা। আশেপাশের দু-পাঁচটা মেয়েও তাকে অনুসরণ করে জীবন সুন্দর করার পরামর্শ রোজই পায় তাদের নিজস্ব বাড়ি থেকে। নীলাঞ্জনার সৌন্দর্যের ব্যখ্যা দেওয়া একটু কষ্টকর বটে। নীল চোখের অধিকারিনী নীলাঞ্জনা তার ধানক্ষেতের মতো প্রশস্ত নমনীয় চুল হাওয়ায় উড়িয়ে যখন আনমনে পথ বেয়ে হেটে যায় তখন যে কোনো সৌন্দর্য প্রেমীর ইচ্ছে হবে নীলচোখী এর সুন্দরী রমনীর চুলের প্রেমে পড়ে যেতে। যখন সে হাসে তখন মেঘগুলো সরে যায় সূর্যের সামনে থেকে যেন সূর্যের ওই রশ্মি তার মুখে পড়ে ঠিকড়ে পড়ে। যখন কান্না ভেজা চোখে চেয়ে থাকে তখন মনে হয় প্রকৃতিও তার সাথে কাঁদতে চায়। এখন তার বয়স ২০। গ্রামেরই একটা কলেজে পড়ে। পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে একটি টিউশনি নিয়েছে অঞ্জনা। যাতে সে নিজেই নিজের খরচের কিছুটা জোগান দিতে পারে। এদিকে দুদিন আগে শুক্রবারে সে যা শুনেছে তাতে তার মনটা খারাপ হয়ে আছে। রাত আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে নীলাঞ্জনার বাবা জাফর নীলাঞ্জনার মা পারভীনা বেগমকে বলছে‚’অঞ্জনার মা শুনছো?মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে না তো? হাসান স্যারের কথা মতো অনেকদূর তো পড়ালাম মেয়েকে। আর কতো?’
পারভীনা বেগম বলল‚’যে ছেলেটা ওকে দেখে পছন্দ করেছে শুনেছি তাঁর অবস্থা ভাল। যদি অঞ্জনা রাজি থাকে তাহলে ওখানেই দিয়ে দেবো।’
এরপর একটু মন খারাপ করে বললো‚’আমাদের তো একটাই মেয়ে।’
জাফর বলল‚’আচ্ছা সেটাই ভালো হবে।’
অঞ্জনা পাশের ঘরে দাদির বিছানা গুছিয়ে দেওয়ার সময় সব শুনেছে। কিন্তু সে এখন বিয়ে করতে চায় না। তার স্বপ্ন বড় চাকরি করবে‚ সবাই শহরে যাবে। কিন্তু‚ সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে কি-না সে ব্যপারে সে এখন অনেকটাই চিন্তিত। সে রাতে ঘুমায়নি সে। আজও সেই চিন্তায় বিষন্ন হয়ে বসে আছে জানালার পাশে। আকাশ দেখছে আর মনে মনে বলছে‚ আকাশের মেঘগুলো কী মুক্ত‚ স্বাধীন! সারা আকাশে ভেসে বেড়ায়। আবার বলছে,না! এরাও স্বাধীন না! বাতাস হলো এদের বাবা-মা। আর আমি হচ্ছি মেঘ। এরকমই আজগুবি কথাবার্তার ভিতর ঘরে আসে ওর বান্ধবী মলি। মলি নীলাঞ্জনাকে বলল‚’চল মেলায় যাই।’
“কিসের মেলা?কোথায় হচ্ছে?’
‘জানিস না?স্কুলের মাঠে বইমেলা হচ্ছে। আসার সময় দেখলাম সাগর বইমেলায় এসেছে।’
শেষ কথাটা বলেই মুচকি হাসি দিলো মিলি। আর অঞ্জনা মিথ্যে মিষ্টি রাগের ভঙ্গীতে তাকালো মলির দিকে। সাগর হলো নীলাঞ্জনাকে পছন্দ করা এক অকর্মণ্য ছেলে। নীলাঞ্জনাও তাকে পছন্দ করে মনে মনে। কিন্তু‚পারিবারিক দিক থেকে ভেবে বারবার পিছিয়ে আসে নীলাঞ্জনা। সাগর তবুও রোজই তাকে ভালোবেসে বেঁচে থাকে। কলেজ যাওয়ার পথে লুকিয়ে অঞ্জনাকে দেখে। সাগর বুয়েট শিক্ষার্থী। ছুটি পেলেই গ্রামে চলে আসে। কারণ‚ পছন্দের জিনিসটা সে গ্রামেই রেখে গিয়েছে। এদিকে সাগরের বাবা সাদেক সাহেব বড্ড রাগী মানুষ। তার সামনে কথা বলার সাহস তার পরিবারের কারও নেই।তাই‚ পারিবারিকভাবে বিয়ের ইচ্ছে প্রকাশ করার সাহস হয়নি তার।
মলি বলল‚’চল যাই।’
নীলাঞ্জনা একটা টুল দিয়ে মলিকে বলল‚’এখানে বস।আমি আম্মুকে বলে আসি।’
বলেই বাড়ির উত্তর পাশের যে ঘরে অঞ্জনার মা-বাবা থাকে সেই ঘরে গিয়ে মাথা নিচু করে মা কে বলল‚’মা মলি এসেছে।’
‘কই?আমার এখানে নিয়ে আয় ওকে।’
ও ঘর থেকে অঞ্জনা মলিকে ডাক দেয়। মলি এসে সালাম দেয় পারভিনা বেগমকে।
‘কেমন আছো মলি? ভাবি কেমন আছে?’
ভাবি বলতে মলির মা শিউলি বেগম।
মলি বলল‚’আম্মু ভালো আছে।আপনাকে যেতে বলেছে। আচার বানিয়েছে সেটা খেতে।’
পারভিনা বেগম হেসে হেসে বলল‚’আচ্ছা কাল যাবো।’
অঞ্জনা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলল‚’মা মলি বলছিলো মেলায় যাবে। আমি কি যাবো ওর সাথে?’
পারভিনা বেগম সাবধান করে দিয়ে বলল‚’যাও। সন্ধ্যার আগে চলে আসবে। সাবধানে যেও।’
অঞ্জনা মহাখুশি। কিন্তু‚ সেই খুশি মনের মাঝেই কবর দিয়ে দিতে হলো তার। নিজের জমানো টাকা নিয়ে ওরা মাঠের দিকে যেতে লাগলো। এমন সময় এলাকার মাহাতাব চেয়ারম্যান এর ছেলে রকি অঞ্জনাকে দেখে ওকে উদ্দেশ্য করে গান গাইতে লাগল দলবল সহ।
‘নীলাঞ্জনা
ওই নীল নীল চোখে চেয়ে দেখো না
তোমার ওই দুটি চোখে
আমি হারিয়ে গেছি
আমি বোঝাতে তো কিছুই পারি না।’
ওরা দ্রুত হাটার চেষ্টা করে। কিন্তু‚ রকিরা বাইক নিয়ে ওদের পিছু নেয়। এভাবে বিরক্ত হতে হতে মেলায় পৌঁছায় ওরা দুজন। মেলার গেইট থেকে বখাটের দলেরা চলে যায়। মেলাতে প্রবেশ করেই নীলাঞ্জনা দেখে সাগর বই পড়ছে স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে। অপলক কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে নীলাঞ্জনা। তারপর মিলির ডাকে স্বাভাবিক হয়ে সাগরের কাছে যায় ওরা। সাগর নিলাঞ্জনাকে দেখে চোখে চোখ রেখে কি যেন ভাবে। নীলাঞ্জনা আজ নীল শাড়ি পরে এসেছে। নীল শাড়িতে ওকে খুব ভালো লাগে।
সাগর বলল‚’কেমন আছো অঞ্জনা?’
নীলাঞ্জনা মাথা নিচু করে লজ্জায় বলে‚’ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
সাগর একটু হেসে বলে‚’আমিও ভালো আছি।
কোনো বই কিনেছো?’
‘না। এইমাত্র আসলাম মেলাতে। এখন কিনবো।’
‘আচ্ছা চলো বই দেখি।’
মিলি আর অঞ্জনা সাগর কে সাময়িক বিদায় জানিয়ে তাম্রলিপি প্রকাশনীর একটি দোকানে গিয়ে হুমায়ুন আহমেদের উপন্যাস দেখছে।
নীলা গোসল শেষ করে আসলো। মা-ই তাকে খাবার দিলো। মেয়ের গতিবিধি তহুরা বেগমের মোটেও ভালো লাগছে না। নীলার বাবার জ্বর অনেকটা কমেছে। তহুরা বেগম তার কাছে গিয়ে বলল‚’মেয়েটা একা থাকে। জামাই আসেনি। ওকে নিয়ে একটু ঘুরতে বের হও।’
বাবার সম্মতি পেয়ে নীলার মা নীলার ঘরে গিয়ে ওকে তৈরী হতে বলে। কারণ জানতে চাইলে তহুরা বেগম বুদ্ধি করে বলে,’মেলা হচ্ছে স্কুলের মাঠে।ঘুরে আয়।’
‘কি মেলা?’
‘বইমেলা বলছিলো মলি।”
মলি এ বাড়ি ঘুরেই নীলাঞ্জনার বাড়িতে গিয়েছিলো। মলির বাবা নীলার বাবার বিশেষ বন্ধু। মলির ভাইয়ের সাথে নীলার বিয়ে দেওয়ার জন্য মনস্থির করলেও নীলার পছন্দের দাম দিয়ে রাতুলের হাতেই তুলে দেয় নীলাকে। মলি নীলার বাবাকে দেখতে এসেছিলো। ওর বাবাই ওকে পাঠিয়েছিলো।
নীলাঞ্জনাও ভাবলো এই একা সময়টা বই পড়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে। তাই আর দেরি না করে বাবার সাথে রওনা দিলো। নীলার বাবা তখনও জানে না মেয়ে মেলায় যাবে। নীলার বাবা ওকে বলল,’কোথায় যাবি?’
‘কেনো?মেলায় যেতেই তো আসলাম।’
একটা ভ্যান নিয়ে ওরা মেলায় গেলো। নীলা শরৎচন্দ্রের লেখা পছন্দ করে। শরৎচন্দ্রের কয়েকটা উপন্যাস কিনলো।
নীলাঞ্জনারা ওই স্টল থেকে ২ টি উপন্যাসের বই কিনে আরও ২-৫ টি স্টল ঘুরে অঞ্জনা মলিকে বলল‚’চল মলি।সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।’
মলি একটু মজা করে বলল‚’সাগর ভাইকে বলে যাবি না?’
অঞ্জনা একটু হাসি মিশ্রিত রাগী গলায় বলল‚’তুই না!সবসময় বেশী বেশী।’
ওদের আলাপের মধ্যে সাগর মুখে একরাশ হাঁসি নিয়ে উপস্থিত হয় ওদের মাঝে। অঞ্জনাকে বলে‚’অঞ্জনা‚ বাড়িতে যাও। সন্ধ্যা হয়ে এলো।’
‘আচ্ছা,আসি।’
অঞ্জনা রকির আচরণটা নিতান্তই চেপে গেলো সাগরের কাছে।
মুচকি হাঁসি দিয়ে সাগরকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো ওরা। সাগর ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ।
ফেরার পথে আবার রকি দলবল নিয়ে ওদের পিছু নিলো। পথে অঞ্জনার বাবাকে দেখে রকিরা ওদের অনুসরণ করা বন্ধ করে সাবধানতার সাথে সরে পড়ে।
অঞ্জনার বাবা ওদের দেখে বলল‚’মেলায় গিয়েছিলে তোমরা?’
মলি বলল‚’হ্যাঁ‚ বইমেলায় গিয়েছিলাম।”
তারপর নীলাঞ্জনার বাবা ওদের নিয়ে বাড়িতে গেলো। নীলাঞ্জনার মা মলিকে বলল‚’আজ তুমি থেকে যাও সন্ধ্যা হয়ে গেছে।’
‘আন্টি‚মা কে তো বলে আসিনি যে থাকবো। চিন্তা করবে।’
‘আমি বলে দিচ্ছি এখন ফোন করে।’
এ কথা বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে নীলাঞ্জনার মা ঘরের ভিতরে গিয়ে মলির মা-কে ফোন করলো। কিছুক্ষণ পর বের হয়ে বলল‚’তোমার মা-কে বলে দিয়েছি মলি।’
‘কিন্তু‚ আমার তো বাবার সাথে একটু কথা বলতে হবে। নীলা আপুর বাবার শরীরের অবস্থা জানতেই তো আমার আসা।’
নীলাঞ্জনার মা আবার কল দিলো মলির মা-কে। ফোনটা মলিকে দিলো। মলি নীলার বাবার শরীরের অবস্থা বর্ণনা করে দিলো। তারপর ফোনটা নীলাঞ্জনার মা-কে দিয়ে ওরা নীলাঞ্জনার ঘরে চলে গেলো।
রাতুল আর অভি গোসল শেষ করে অভির মায়ের হাতের রান্না খেল। তারপর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় চা খেতে বের হলো। গ্রামের দোকানে অনেক মানুষ-ই সারাদিনের কাজ শেষে চা খেতে আসে। একে অপরের খবর নেয়‚ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা-ও হয়। এমন সন্ধ্যায় গ্রামের চায়ের দোকানে চা খাওয়ার অভিজ্ঞতা রাতুলের জন্য একেবারে নতুন। কিন্তু‚ এই নতুন পরিবেশেও সে ঠিকঠাক মানিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আসলে মানুষ যদি নতুন কোনো অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয় এবং সেখানে একজন ভালো বন্ধু বা অভিজ্ঞ সহযোগী থাকে তবে সে অভিজ্ঞতা গ্রহণ অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়। অভির গ্রামের সমস্ত বিষয় রাতুলকে বুঝিয়ে দিয়েছে। গ্রামে যথেষ্ট পরিচিতি আছে অভির। দোকানে গিয়ে বসতেই রহিম চাচা চশমাটা একটু নেড়েচেড়ে রাতুলের দিকে তাকালো। গ্রামের ছেলে-বুড়ো সবাই তাকে চাচা বলেই ডাকে। ভীষণ রসিক মানুষ সে। অভির দিকে তার খেয়াল নেই। রাতুল গ্রামে নতুন। বেশ লম্বা চুল‚ চশমাটা ঢেকে গেছে চুলে শুধু গ্লাসটা একটু দেখা যায়‚ হাতে একটা ডায়েরি। এমন অবস্থায় গ্রামের আর কাউকে দেখা যায় না। তবে‚ রহিম চাচার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আর-ও কিছু একটা পরিবর্তন করলে বেশ লাগতো।
অভি রহিম চাচার চাহনি দেখে বলল‚’এমন করে কি দেখো চাচা?’
রহিম চাচা বেশ কৌতূহলপূর্ণ স্বরে অভিকে বলল‚’এই পোলাডারে নতুন দেখতাছি বাবা,তাই একটু আন্দাজ করতিছিলাম কে সে। হ্যায় কি শহরে থাহে?’
‘আরে হ্যাঁ।ও আমার বন্ধু।’
‘ওর বেশভূষার লগে জামাডা ভাল্লাগে না। একখান পাঞ্জাবী পরতে পারেন না‚ বাবা?’
রাতুল তাঁর পরিচয় আগেই পেয়েছে অভির কাছ থেকে। আসার পথে চায়ের দোকানের সমস্ত বর্ণনা সে পেয়েছে রহিম চাচা হলো চায়ের দোকানটার নিয়মিত খদ্দের। ছেলে মেয়ে শহরে থাকে। খোঁজ-খবর নেয় না। সে জানে এখন তার কি বলা উচিৎ।
রাতুল বলল‚’চাচা পাঞ্জাবী আমি আনতে ভুলে গেছি। আসলে তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছি কি-না।’
‘আচ্ছা‚ বাবা।নাম কি আপনের?’
রাতুল একটু হেসে বলল‚’আমাকে তুমি করে বলেন চাচা।আমি আপনার অনেক ছোট।ছেলের মতো।আমার নাম রাতুল।’
নামটা শুনেও সে খুশি হতে পারলো না। ওই বেশভূষার সাথে এই নাম মানায় না।
সে বলল‚’ছেইলের মতন,ছেইলে তো আর না!’
বলেই বেঞ্চ থেকে উঠে হাঁটা শুরু করলো। ওরা ডাকলেও পিছনে ফিরলো না রহিম চাচা। হাঁটতে হাঁটতে মিলিয়ে গেলো অন্ধকারে।
‘চাচা এরমই। আচমকা আসে আর আচমকা চলে যায়।’ চায়ের কাপ ধুতে ধুতে বলল দোকানী জমিরউদ্দীন। জমিরউদ্দীনের এই ছোট্টো দোকান। ছেলে-বউ নিয়ে খেয়ে-পরে বাঁচে। কিন্তু‚ এলাকার উঠতি বয়সী ছেলেদের জন্য বিক্রির চেয়ে সেবাই ইদানীং বেশি করতে হয় তাঁর। এইসব বিষয় নিয়ে আলোচনা চলতে লাগলো।…
‘ভাবি‚ আপনার সেই ভাই কবে আসছে অঞ্জনাকে দেখতে? দ্রুত বিয়েটা দিয়ে দিতে চাই‚ ভাবি। জানেনই তো অবস্থা। নিজে শিক্ষিত হয়ে কিছু কর‍তে পারলাম না‚ মেয়েও পারবে না।’ মলির মা’কে মোবাইলে বলতে লাগলো অঞ্জনার মা।
‘ভাবি‚ আমি খবর পাঠাচ্ছি। দু-একদিনের মধ্যে আসতে বলবো। এগুলো নিয়ে বেশি ভাইবেন না।’
‘আপনারও মেয়ে আছে। আপনিও জানেন মেয়ের বিয়ে নিয়ে কী চিন্তা হয়!’
‘আচ্ছা‚ তাড়াতাড়ি কিছু ঘটিয়ে দিই। কী বলেন?’
‘উমমম।’
অভি হলো মলির মায়ের দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই। পারিবারিকভাবে অভিরা অভিজাত এবং শিক্ষিত। মলির মা-ও। মলির মা খবর পাঠালো অভির মা’কে যেন দ্রুত ওরা অঞ্জনাকে দেখতে আসে। পছন্দ হলে পাকা কথাও হয়ে যাবে এখানেই। রেজিস্ট্রিও করে ফেলতে পারে।
রাত তখন ন’টা। অভি আর রাতুল বাড়ি ফিরেছে। মা ওদের খাবার দিয়ে পাশে বসে পাত্রী দেখতে যাওয়ার কথা বলল। অভি বলল‚’আমি তো দেখেছি‚ মা। তুমি আর রাতুল গিয়ে দেখে এসো।’
‘আমরা তো যাবোই। তুই ও যাবি। দু’জন- দু’জনকে পছন্দ করলে খাতা-কলমে বিয়ে সেরে ফেলবো। বাবা রাতুল‚ তুমি গোছগাছ করে নাও। পরশু আমরা যাবো।’
রাতুল বলল‚’গ্রামের নাম কি? কোন জায়গা?’
‘ঝিকরগাছা। যশোর।’
রাতুল থেমে গেল। ‘হ্যাঁ, না’ কিছুই বলতে পারলো না। কীসের যেন ভয় ওর গলা চেপে ধরলো। নাকেমুখে খেয়ে এ নিজের ঘরে চলে গেল। ঘরটা গুছিয়ে রেখেছে অভির মা। তাঁর বয়স হয়েছে। এখন আগের মতো কাজ করার শক্তিও নেই। এতবড়ো সংসার চালাতেও তো একটা মানুষ লাগে।
অঞ্জনা জানে আজ তাঁকে দেখতে আসছে। ওর মনখারাপ। যে সম্পর্ক গড়েই উঠতে পারেনি তাঁর জন্য এত মনখারাপ! আসলে প্রেমাবেগ মানুষকে শিশু বানিয়ে দেয়। অল্পেই ব্যথা দেয় পাহাড়সম। কিন্তু‚ এ ব্যথা তো অল্প নয়। ‘যে মানুষ আমার ছিলো না তাঁকে হারানোর এত কেনো ভয় আমার!’ মনে মনে বিড়বিড় করতে লাগলো অঞ্জনা। ওর বাড়িতে উৎসব। মলি এসেছে। ওকে ডাকলো। অঞ্জনা সাড়া দিলো না। ঘরে এসে মলি ওর পাশে বসলো।
‘কী-রে? কি হয়েছে?’
‘জানিস না? বুঝিস না?’
‘কী বুঝবো। তুই কি প্রেম করিস? ভালোবাসিস কাউকে?’ মুখে হাসি চেপে জানতে চাইলো মলি।
‘জানি না।’
হাসিতে ফেঁটে পড়লো মলি। ‘যা সম্ভব না তা নিয়ে মনখারাপ করছিস? হাহাহা..’
মলি এমনিই। খুব শক্ত। ও বলল‚’অভি ভাইয়া কিন্তু অনেক ভাল। যেমন দেখতে তেমন ব্যবহার। দেখ কি করবি।’
‘আমার কিছু ভাল লাগছে না রে।’
রাতুল জানে ওই গ্রামে ও যেতেই পারবে না। কাজ আছে বলে এ যাত্রায় রক্ষা পেতে চাইলো। পেয়েও গেল।
.
.
.
.
.
অল্প শীত পড়া শুরু করেছে। এর মধ্যে অনেককিছু ঘটে গিয়েছে। অভি-অঞ্জনার বিয়ে খাতা-কলম থেকে সামাজিকভাবে সম্পূর্ণ হতে দু’দিন বাকি। সাগর ঢাকা থেকে আর বাড়ি ফেরে না বহুদিন হয়। গ্রামের প্রতি টান যেন মলিন হয়ে গিয়েছে। কার জন্য আসবে! কার কাছে আসবে! নীলাঞ্জনার পরিবার খুশিতেই আছে। নীলার ছোটোবোন বাড়িতে এসে আবার চলেও গেল সেই কবে! নীলা ভাবে রাতুলের সাথে তো দেখা হলো না। মা-বাবাকে সব বলতেই হয়েছে তাঁকে। আর কতদিন গোপন করা যায়! রাতুল নিজের বাবা-মায়ের সাথে মাঝেমাঝে যোগাযোগ রাখতো। তাঁরাও জানে রাতুল বিদেশে। নীলার বাবা-মা এখন নীলার সাথে ঢাকায় থাকে। মাসখানেক আগে চলে এসেছে গ্রাম ছেড়ে। নীলা ই নিয়ে এসেছে। সবাই অল্প অল্প করে সবকিছু মানিয়ে নিয়েছে। এতদিনে অভির মায়ের দ্বিতীয় ছেলে হয়ে উঠেছে রাতুল। এখন ওর মা জানে রাতুল-নীলার সম্পর্কে। কেন সে বিয়েতে যেতে চায় না সেটাও সে জানতে পেরেছে খোঁজ-খবর করে। গায়ে হালকা গরম পোশাক চাপিয়ে রাতুল ভাবছে নীলা ওকে মনে করে কি-না রোজ। কল এলো। মায়ের কল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নার শব্দ এলো। ‘বাবা‚ কতদিন বাড়ি আসিস না। কল দিলে পাই না তোরে। তোরে দেখতে সাধ হচ্ছে।’
‘আচ্ছা‚ আসবো। কেমন আছো তোমরা?’
‘আআর থাকা।’ কল কেঁটে গেল।
অভির মা এলো ঘরে। ‘একটা অনুরোধ করবো‚ বাবা? বল রাখবি?’
‘অনুরোধ কেনো? বলুন কি বলবেন।’
‘বন্ধুর বিয়েতে চল‚ বাবা। আমার বয়স হয়েছে‚ এই অনুরোধটুকু রাখ।’
রাতুল চুপচাপ। এই কথা অমান্য করতে সে পারবে না।
নীলা মা’কে হাতে হাতে রান্নায় সাহায্য করছে। এখনও শিখছে সে। কতটুকু লবন-ঝালে রান্না হয় অদ্ভুত সুন্দর তাই দেখছে অপলক। মাঝেমধ্যে দু-একটা কথা বলছে। আজ নীলাঞ্জনার বিয়ে। বেশ ধুমধামে নয়ে দেওয়া হচ্ছে বাড়ির একমাত্র মেয়ের। নীলার লোকসমাগম ভাল লাগে না ইদানীং। তাই‚ সে বিয়েতে যাবে না বলে মনস্থির করে। ঢাকা থেকে অনেকটা পথ। এদিকে সকালের একটু পরেই অভিকে এবং সাথে কিছু লোক নিয়ে রাতুল পৌঁছে গিয়েছে ওদের গ্রামে। মনের মধ্যে অজানা ভয়‚ সংশয় আর লজ্জা। বিবাহিত স্ত্রী’র সাথে এতদিনের দূরত্ব বড়োই সমীচীন নয় সেটা বুঝতে পেরেছে সে। এতদিন দূরে থেকেও রাতুলের মনে হয়নি যে নীলার নতুন সংসার হতে পারে‚ মনের মতো একটা স্বামী পেতে পারে। কেবল ভেবেছে নীলা ওর জন্য আজও অপেক্ষা করছে। বেওয়ারিশ প্রেম কোনো শূন্যতার জন্য আজও তুলে রেখেছে মনের গহীনে। রাতুল এতক্ষণ জানতো না যে কনেপক্ষের বাড়ি নীলার বাড়ির ঠিক পাশেই। বিয়ের পর টুকটাক যা শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে তা ওই ঘরের সীমাতেই আঁটকে থাকা। আশেপাশের একটা কাকপক্ষীও ওকে চেনে না। কনের বাড়ি পৌঁছে সে একবার উঁকি দিলো নীলার বাড়ির দিকে। বাড়ি শুনশান। হাঁস-মুরগির অবাধ চলাচলে যে বাড়ি মুখর থাকতো যে বাড়ি সেই বাড়িতেই আর কী তীব্র নিরবতা! রাতুলের বুক খালি হয়ে এলেও মনে হলো বুকের উপর থেকে পাথর সরে গেল। অথচ‚ এমন এক শীতের সকালে ওদের দেখা হওয়ার কথা ছিলো। হবে কি দেখা?
বিয়ে মিটে গেল। অভির মায়ের আশাটা মিটলো না কেবল। তবুও‚ অভির মা খুশি‚ অভি খুশি। নীলাঞ্জনাও নিজেকে মানিয়ে নিলো বিংশ শতাব্দীর বুদ্ধিমতী মেয়ের মতো। ওদের সংসার জীবন দেখে রাতুলের মনে পড়ে গেল নীলার সাথে কাঁটানো সুখের দিনগুলো। কী অনবদ্যতা লেগে ছিলো সেই দিনগুলোতে। এসব ভেবেই অনেক বেশি নস্টালজিক হয়ে গেল রাতুল। ওর বুক জুড়ে শূন্যতা। সেই শূন্যতায় পূর্ণতা আনতে ব্যাগ গুছিয়ে রাতেই রওয়ানা করলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। ট্রেনে রাতুল যতটা সময় বসে পুরোটা সময় পুরনো দিন‚ কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রেম‚ আড্ডা মনে করতে লাগলো। আদৌ নীলাকে পাবে কি-না জানে না সে। সকাল সকাল ট্রেন থামলো কমলাপুর রেলস্টেশনে। সূর্যের দেখা নেই। তীব্র কুয়াশায় দেখা যায় না কিছু। ঝাপসা‚ অস্পষ্ট ভীষণ! হঠাৎ‚ বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের নামধারী ডাকে থমকে গেল রাতুলের পা। আর এক পা এগোতে পারছে না সে। এগোতে চাচ্ছে না সে। সেই অমিত শক্তি তাঁর এখনও হয়নি। পিছু না ফিরেই বুঝে গেল নীলার ডাক। ও ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না কোনো এক অজানা কারণে। গায়ে কালো শাল জড়ানো নীলা রাতুলের সামনে এসে দাঁড়ালো। রাতুলের চোখে-মুখ তখন কুয়াশা আর আবকে ভিজে গিয়েছে ভীষণ। উষ্কখুষ্ক চুলে শুভ্র কুয়াশা। চশমার কাচ অস্পষ্ট। নীলা পুরনো দিনের চশমা খুলে চোখ-মুখ মুছে দিয়ে আবার চশমা পরে বলল‚’কেমন আছো‚রাতুল? আমাকে কেমন লাগছে? দ্যাখো‚ তোমার মতো শাল জড়িয়েছি গায়ে। আমি শীতের এই সকালগুলোতে রোজ এখানে আসি। তুমি এখানে কি মনে করে? কোনো কাজে এসেছো? কোথায় ছিলে? বাড়ি ছিলে এতদিন? মা-বাবা কেমন আছে?’
রাতুলের গলার স্বর শুনতে কী ভীষণ ব্যস্ততা তাঁর! অনবরত প্রশ্ন করেই চলেছে।
এত প্রশ্নের ভার সইতে না পেরে রাতুল নীলাকে শক্ত জড়িয়ে ধরলো।

Leave a Reply